Wednesday, June 13, 2012

কৃষিবাজেট :কৃষকের আশা পূরণহয়নি

উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য ৮ হাজার ৯১৭ কোটি ৫২ লক্ষ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বাজেট ঘোষণায় এবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কৃষির গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। তুলে ধরেছেন কৃষিক্ষেত্রে চালু বেশকিছু কর্মসূচির কথাও। কিন্তু আগামী অর্থবছরে কৃষক খামারিদের দাবি ও প্রত্যাশাগুলো খুব বেশি আমলে এসেছে বলে মনে হয় না। অধিকাংশ কৃষকের দাবি ছিল উপকরণ সুলভে প্রাপ্তি ও উত্পাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য। কৃষি খাতে গত বছরের তুলনায় ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি কমেছে। এবার বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা। যদিও গত বছরের ব্যয় না হওয়া ৩ হাজার কোটি এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে দাঁড়াবে ৯ হাজার কোটি টাকা। এই হিসাব ধরলে তাতে কম বলা যায় না। কৃষি খাতের জন্য এবার বিভিন্ন পরিকল্পনা ও দিক নির্দেশনার কথা উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু ওই বিবরণীতে কৃষক ও খামারিদের জন্য তেমন কোনো সুখবর নেই।
এবারের বাজেটের কৃষি খাত মূলত গত বছরের বাজেটেরই একটি প্রতিচ্ছবি মাত্র। গত বাজেটের বরাদ্দ ও পরিকল্পনার বিবরণগুলো এবারও তুলে ধরা হয়েছে। আগামীর পরিকল্পনা এসেছে কম। কৃষিতে সরকারের বহুল আলোচিত সাফল্যের অংশ হিসেবে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কৃষকদের উন্নয়নকল্পে ১ কোটি ৪০ লক্ষ কৃষককে ‘কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড’ প্রদান করা হয়েছে। মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক একাউন্ট খোলার সুযোগ পেয়েছেন তারা। উল্লেখ করা হয়েছে, এবারের আউশ মৌসুমে কৃষকদের জন্য প্রদত্ত সহায়তার কথাও। উফশী আউশ ও বোনা আউশ (নেরিকা) উত্পাদনের জন্য ৫৬টি জেলায় ৩ লক্ষ ৬৫ হাজার ২০৬ কৃষক পরিবারকে দেয়া হয়েছে বিনামূল্যে সার ও বীজ। একই সাথে ৩৫টি জেলায় কৃষকদের মাঝে ভর্তুকি মূল্যে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টরসহ বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে, গত তিন বছরে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সারের ভর্তুকি বাবদ ১৭ হাজার ৯২ কোটি টাকা প্রদান করার কথাও।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় কৃষক পর্যায় থেকে সংগৃহীত তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথাও উল্লেখ করেছেন। ময়মনসিংহে কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মন্ত্রী নিজেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন বীজ নিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন কৃষক। তিনি এবার বাজেট বক্তৃতায় সে কথাই উল্লেখ করে বলেছেন, ‘উন্নতমানের বীজের অভাব রয়েছে আমাদের দেশে। কৃষক প্রায়ই দোকানীর প্রলোভনে ভাল জাতের বীজ কিনে ক্ষেতে বুনে শেষে প্রতারিত হয়। ভাল জাতের বীজের চাহিদা থাকলেও বিএডিসির সরবরাহকৃত বীজ সে চাহিদা মেটাতে পারে না। তাই উন্নতজাতের বীজ সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনকে শক্তিশালী করা হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিএডিসি মাত্র ১৮ শতাংশ বোরো বীজ সরবরাহ করত। বর্তমানে প্রায় ৬০ শতাংশ বোরো বীজ সরবরাহ করছে।  মানসম্মত বীজ সহজলভ্য করার জন্য ‘সার্কসিড ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এছাড়া হাইব্রিড ধান চাষের আওতা বাড়ছে।’ কিন্তু এর বাইরে বিএডিসি’র বীজ উত্পাদন সাধ্য বৃদ্ধির জন্য আগামী অর্থবছরের জন্য তেমন কোনো দিক নির্দেশনা আসেনি।
এবারের বাজেটে বরাদ্দ ও নতুন দিক নির্দেশনা রয়েছে কম। তবে অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন কৃষির গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর কথা। যদিও সমাধানের কোনো কৌশল ও বরাদ্দের কথা উল্লেখ করা হয়নি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে ক্রমশ মাটি হয়ে যাচ্ছে অনুর্বর। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় অজৈব সারের পাশাপাশি জৈব সারের উত্পাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। গত তিন বছরে ৬৮ লক্ষ কম্পোস্ট সারের স্তূপ মনিটরিংসহ ২০ লক্ষ নতুন কম্পোস্ট সারের স্তূপ স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি এ সময়ে লাগসই আধুনিক প্রযুক্তির ওপর ১৫ লক্ষ ৮৭ হাজার কৃষক ও ৫৬ হাজার ৬৫৯ জন সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই উদ্যোগগুলো বিগত বছরগুলোর একটি ধারাবাহিক কার্যক্রমের অংশ। এবার নতুন কিছুই যুক্ত হয়নি।
পোল্ট্রি খাত একেবারে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হলেও এবার বাজেটে এই খাতের জন্য নেই তেমন কোনো বরাদ্দ ও নির্দেশনা। আশার বাণী হিসেবে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, অগামী অর্থবছরে বাজেটে এ খাতে দেয়া প্রণোদনা অব্যাহত রাখা হবে। তিনি উল্লেখ করেছেন বিগত অর্থবছরে নেয়া ভুট্টা চাষের উদ্যোগের কথা। তিনি গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, খাদ্যের অন্যতম উপাদান হল ভুট্টা। ২০১১-১২ অর্থবছরে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের ভুট্টা আবাদে সহায়তার জন্য ৫ কোটি ৬৯ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। পাশাপাশি ভুট্টা চাষের জন্য বর্তমানে ৪ শতাংশ হারে কৃষি ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে প্রায় ১৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এপ্রিলে ২০১২ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ৭৩.৯ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ৩’শ ৩০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১৪ হাজার ১৩০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে শস্যবীমা বিষয়ে কৃষকরা দাবি জানিয়ে আসছিলেন। বিষয়টি পর পর কয়েক বছর কৃষকের সুপারিশ আকারে অর্থমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হয়। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় চলতি অর্থবছরে নেয়া সরকারের উদ্যোগের কথা পুনরুল্লেখ করেন। বলেন, গত বাজেটে শস্যবীমা প্রচলনের লক্ষ্যে পাইলট কর্মসূচি চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। ইতোমধ্যে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের আওতায় পাইলট ভিত্তিতে শস্যবীমা স্কিম চালু করা হয়েছে।
কৃষক যাতে তার উত্পাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান সে লক্ষ্যে অঙ্গীকার অনুযায়ী ইতোমধ্যে ৪৯০টি কৃষি বিপণন দল, ১৮ হাজার কৃষক ক্লাব, ৬০টি উপজেলায় গ্রোয়াস মার্কেট এবং ২১টি জেলায় পাইকারী বাজার নির্মাণ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরে সারাদেশে ৮টি এ্যাসেম্বল সেন্টার নির্মাণ এবং ৮০০ কৃষক দল গঠন করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, কৃষকদের তথ্য প্রাপ্তিতে কৃষি তথ্য কেন্দ্র, ভিডিও কনফারেন্স ও এসএমএস এর মাধ্যমে কৃষককে তার সমস্যার সমাধান দ্রুততম সময়ে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা চলছে। বর্তমানে ৯৫টি ইউনিয়নে কৃষি তথ্য যোগাযোগ কেন্দ্র চালু করা হয়েছে এবং আরো ১৫০টি ইউনিয়নে এ কেন্দ্র চালু করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে মোট ৯৪৯ কোটি ৭৩ লক্ষ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় মাত্র ২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা বেশি। অর্থমন্ত্রী এই দু’টি খাতের গুরুত্ব ও অবদানের কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ উপ খাতটির গুরুত্ব অপরিসীম। এই উপ খাত থেকে জাতীয় উত্পাদনের ৮ শতাংশ আসছে। একই সাথে পূরণ করছে দেশের দৈনন্দিন খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে মত্স্য উত্পাদন ৩২.২ লক্ষ মেট্রিক টনে উন্নীত হবে। উন্মুক্ত জলাশয়ে পোনা অবমুক্তকরণ কার্যক্রমকে আরো জোরদার করা হয়েছে। দেশের নদ-নদী ও জলাশয়ে মাছের অভয়াশ্রমের সংখ্যা ৫০০ তে উন্নীত করা হয়েছে। এর ফলে ১২টি বিলুপ্তপ্রায় মত্স্য প্রজাতির পুনরাবির্ভাব ঘটেছে। ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করা হয়েছে। চিংড়ি খামারের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। সাথে সাথে মত্স্য খাত ভিত্তিক ই-সেবা প্রদানের সুযোগও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। কিন্তু মত্স্যখাতে খামারিরা গত পাঁচ বছর ধরে জানিয়ে আসছে একই দাবি, তা হল মত্স্য খাতকে কৃষির সমপরিমাণ গুরুত্ব দেয়া হোক। ভূমি কর প্রত্যাহার করা হোক, বিদ্যুত্ বিল কৃষি খামারের হিসেবে গণ্য করা হোক। দেশের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে মত্স্য চাষ সিংহভাগ অবদান রাখলেও খামারিদের দাবি ও প্রত্যাশা বারবারই মূল্যায়ন হচ্ছে না।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আন্তর্জাতিক আদালতের রায় প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে বঙ্গপোসাগরে বাংলাদেশের নতুন সমুদ্র সীমানা নির্ধারিত হওয়ায় বর্তমানের ১ লক্ষ ৬৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার বাইরে আরো ১ লক্ষ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার উপর আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ সম্প্রসারিত এলাকায় নতুন নতুন মত্স্য আহরণ ক্ষেত্র চিহ্নিত করার মাধ্যমে এ খাতে অপার সম্ভবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। উপযুক্ত গবেষণা, আইনি কাঠামো ও প্রণোদনার ফলে আগামী বছরে এই উত্পাদন আরো বৃদ্ধি পেয়ে মেস্যর উত্পাদন ৩৪ লক্ষ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে। উল্লেখ্য যে, কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট শীর্ষক কার্যক্রমের আওতায় গত কয়েক বছর ধরে মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের উত্পাদন বৃদ্ধি ও উন্নয়নের প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী আশা জাগানিয়া কিছু তথ্য তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, দুধের উত্পাদন দাঁড়াবে ৩০ লক্ষ মেট্রিক টন, মাংসের উত্পাদন দাঁড়াবে ২০ লক্ষ মেট্রিক টন এবং উত্পাদিত ডিমের সংখ্যা দাঁড়াবে ৭৯১ কোটি। নানা প্রণোদনা প্রদান করেও দুধের উত্পাদন এখনো চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশে স্থবির হয়ে আছে। কিন্তু এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা যে সংকট মোকাবিলা করছেন, সে সংকটগুলো সমাধানে কোনো বরাদ্দ ও নির্দেশনা নেই বাজেটে। দুধের আমদানি শুল্ক কয়েক বছর ধরে লাগাতারভাবে কমানোর কারণে দেশের খামারিরা চরমভাবে মার খাচ্ছে। মার খাচ্ছে দুগ্ধ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা ও শিল্প মালিকরা। দেশের মোট ব্যবহার হওয়া দুধের মাত্র ১৬ ভাগ আমদানি করা গুঁড়ো দুধের ওপর নির্ভরশীল হলেও সেই আমদানি খাতকেই বরাবর উত্সাহিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে দেশে গুঁড়ো দুধ উত্পাদনের যথেষ্ট সাধ্য থাকলেও কোম্পানিগুলো দুধ বিক্রি করতে পারছে না। খামারিদের কাছ থেকে কিনতে পারছে না দুধ। সার্বিকভাবে কৃষি খাত নিয়ে কৃষক ও খামারিরা এবারের বাজেটে যে আশায় বুক বেঁধেছিলেন, তার তেমন সাড়া নেই অর্থমন্ত্রী ঘোষিত ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে। বাজেটে যে সমস্যা ও সংকটের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন, বাজেট চূড়ান্ত হওয়ার আগেই সেগুলো সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হবে এমনটাই প্রত্যাশা সবার।

2 comments:

  1. its a great step to ensure our food supply.

    ReplyDelete
  2. yes , we should give top priority to agriculture sector of Bangladesh .

    ReplyDelete