খাদ্য নিরাপত্তায় খরাসহিষ্ণু ধান,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
জলবায়ু
পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা খরাপ্রবণ অঞ্চলে পরিণত
হচ্ছে। এই মুহূর্তে ১ মিলিয়ন হেক্টরের বেশি জমি ইতোমধ্যেই খরাকবলিত অঞ্চলে
পরিণত হয়েছে এবং তা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আবার অসময়ে বৃষ্টিপাত এবং বিলম্বিত
বর্ষার কারণে কৃষকরা উপযুক্ত সময়ে আমন ধানের চারা রোপণ করতে পারছে না। আবার
অঙ্গজ বৃদ্ধির পর্যায়ে বা ফুল আসার সময়ে অথবা দানা বাধার সময়ে প্রয়োজনীয়
বৃষ্টি না হলে ধানের ফলন আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে। খরার মাত্রা বেশি হলে
অনেক সময় সম্পূর্ণ ফসলই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই প্রতিকূল অবস্থার সাথে খাপ
খেয়ে কাংখিত মানের ফসল চাষাবাদ করতে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের
(ইরি) সহায়তায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ধান ৫৬ নামে একটি
খরাসহিষ্ণু স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে, যা খরা মোকাবিলায় যথেষ্ট
কার্যকর বলে বিভিন্ন গবেষণা ও কৃষকের মাঠে প্রমাণিত হয়েছে। এই জাতটির বীজ
বপণের ১১০ থেকে ১১৫ দিনের মধ্যেই ধান কাটা যায়। সে কারণে কৃষক কার্তিক
মাসের আকালের সময়েই এই ধান ঘরে তুলতে পারবে। কৃষকের মাঠে খরা মোকাবিলায়
অত্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত ধানের এই জাতটি (লাইন নম্বর আই আর
৭৪৩৭১-৭০-১-১) ভারতে ২০০৯ সালে শাহবাগী ধান এবং ২০১০ সালে নেপালে সুকা ধান ৩
নামে অনুমোদন পায়, যা এখন ভারত ও নেপালের খরাপ্রবণ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চাষ
হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় বীজ বোর্ড ২০১১ সালে ব্রি ধান ৫৬ নামে এই
জাতটিকে অনুমোদন দেয়। বাংলাদেশের কৃষক খরাপ্রবণ অঞ্চলে আমন মৌসুমে এই জাতের
ধান চাষাবাদ করে কাংখিত মানের ফসল ঘরে তুলতে পারবে।
ইরি ও ব্রির
সহায়তায় স্ট্রাসার বিভিন্ন প্রকল্পে আরডিআরএস দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ
করে খরাপ্রবণ অঞ্চলে গত দুই মৌসুম ধরে এই জাতটির খরাসহিষ্ণুতা পর্যবেক্ষণ
করেছে এবং কৃষকের মাঠে নতুন উদ্ভাবিত এই জাতটির গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণিত
হয়েছে। প্রচলিত জাতের আমন ধান মাটির প্রকারভেদে যেখানে ৮ থেকে ১২ দিনের
বেশি খরা সহ্য করতে পারে না, সেখানে ব্রি ধান ৫৬ জাতের ধান ২৭ দিন পর্যন্ত
খরা সহ্য করতে পারে। তাই খরাতে যখন কৃষকের ফসল নষ্ট হচ্ছে, আমাদের খাদ্য
নিরাপত্তাবলয় ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে এই উদ্ভাবন
আমাদের স্বস্তি দিচ্ছে। এই ফসলের আরেকটি গুণ হল- কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে
পোকা-মাকড়ের যে উপদ্রব শুরু হয়, ব্রি ধান ৫৬ স্বল্পমেয়াদি হওয়ার কারণে
পোকা-মাকড় উপদ্রব শুরু হওয়ার আগেই ধান কেটে ফেলা যায়। এতে কৃষক কীটনাশক
প্রয়োগের খরচ থেকে রেহাই পায়, যা পরিবেশ সহায়ক। এছাড়াও স্বল্পমেয়াদি হওয়ার
কারণে কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে খরার কবলে পড়ার আগেই যেহেতু এ ধান পেকে যায়,
সে কারণে সম্পূরক সেচের প্রয়োজন হয় না বিধায় বাড়তি খরচ থেকেও কৃষক অব্যাহতি
পায়।
উত্পাদন কলাকৌশল: সাধারণত খরাপ্রবণ এলাকায় এই ধরনের
খরাসহিষ্ণু ধানের চাষ করতে কৃষকদের উত্সাহিত করা হয়। যেহেতু জলবায়ু
পরিবর্তনজনিত কারণে এখন বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গাতেই খরাজনিত সমস্যায় আমন
ধান চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সে কারণে ব্রি ধান ৫৬ জাতের ধান চাষ বাংলাদেশের
প্রায় সব জায়গাতেই আমন মৌসুমে করা যেতে পারে। বিশেষ করে যে সমস্ত জমিতে
রবিশস্যের চাষ করা হয়, সে সমস্ত জমিতে আমন মৌসুমে ব্রি ধান ৫৬ জাতের ধান
চাষ করা উচিত। এতে কৃষক খরার সময়েও আমন ধানের কাংখিত ফলন পাবেন এবং পরবর্তী
রবি ফসল সঠিক সময়ে চাষ করে বেশি ফলন ঘরে তুলতে পারবেন।
চাষ উপযোগী জমি: বেলে দো-আঁশ এবং এঁটেল দো-আঁশ উঁচু এবং মাঝারি উঁচু জমিতেও এই ধান চাষ করা যেতে পারে।
বীজ বাছাই ও শোধন: ভারী, পুষ্ট ও রোগ-বালাই মুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে।
বপনের আগে বীজ শোধন করা ভাল। হেক্টরপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ কেজি বা বিঘাপ্রতি
২.৫ থেকে ৩.০ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। এক কেজি বীজ শোধনের জন্য তিন গ্রাম
ব্যাভিস্টিন এক লিটার পানিতে মিশিয়ে সারারাত ভিজিয়ে রাখলে বীজ শোধন হয়।
বীজতলায় বীজ বপন: এক শতক পরিমাণ বীজতলায় ৩.৫ থেকে ৪.০ কেজি বীজ বপন করা
যায়। এক শতক বীজতলার চারা দিয়ে প্রায় এক বিঘা জমিতে চারা রোপণ করা যাবে। ১
জুলাই থেকে ১৫ জুলাই বীজতলায় বীজ বপন করা যাবে।
বীজতলা তৈরি: দো
আঁশ ও এঁটেল মাটি বীজতলার জন্য ভাল। বীজতলার জমি অর্নুবর হলে প্রতি শতাংশ
জমিতে ২ মণ পচা গোবর সার দিয়ে বীজতলা উর্বর করতে হবে। এরপর ৩ মিটার লম্বা ও
১ মিটার চওড়া বেড তৈরি করতে হবে। দুই বেডের মাঝখানে ২৫ থেকে ৩০ সেমি নালা
রাখতে হবে যা বীজতলায় পানি দিতে এবং প্রয়োজনে পানি নিষ্কাশনের জন্য সহজ হয়।
রোপণের জন্য জমি তৈরি: জাতটির চাষাবাদ পদ্ধতি অন্যান্য উফশী রোপা আমন
জাতের মতই। জমি চাষে হেক্টরপ্রতি ৩ থেকে ৫ টন পরিমাণ জৈব সার (গোবর সার বা
পচা আর্বজনা) দিলে ভাল ফলন পাওয়া যাবে।
চারা রোপণ: জুলাই মাসের
তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ অর্থাত্ শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহ
থেকে তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ২০ থেকে ২২ দিনের চারা রোপণ করতে হবে। যেহেতু এই
ধান স্বল্পমেয়াদি, তাই ২০-২২ দিনের বেশি বয়সের চারা রোপণ করলে ফলন কম হবে।
প্রতি গুছিতে ২ থেকে ৩টি চারা রোপণ করতে হবে। বেশি গভীরতায় চারা রোপণ করলে
চারার বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং কুশির সংখ্যাও কমে যায়। সারিবদ্ধভাবে চারা
রোপণ করতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০ সেসি এবং প্রতি
সারিতে চারা থেকে চারার দূরত্ব ১৫ সেমি বজায় রাখতে হবে। তবে অনুর্বর মাটির ক্ষেত্রে রোপণের দূরত্ব একটু কমানো যেতে পারে।
সার প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনা: জমি প্রস্তুতের সময় সবটুকু টিএসপি, অর্ধেক পটাশ
সার, অর্ধেক জিপসাম এবং অর্ধেক জিংক সালফেট সার একসাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
ইউরিয়া সার সমান দুই কিস্তিতে অর্থাত্ রোপণের ১০ দিন পর ১ম কিস্তি, ২০ থেকে
২৫ দিন পর ২য় কিস্তি প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক পটাশ সার ২য় বার ইউরিয়া
উপরি প্রয়োগের সাথে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক জিংক সালফেট ১ম কিস্তি
ইউরিয়ার সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। সালফারের অভাব পরিলক্ষিত হলে জিপসাম
ইউরিয়ার মত উপরি প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া উপরি প্রয়োগের সময় জমিতে যেন ২
থেকে ৩ সেন্টিমিটার পানি থাকে ইউরিয়া প্রয়োগের সাথে সাথে আগাছা পরিস্কার
করতে হবে যাতে সার মাটিতে ভালভাবে মিশে যায়। আগাছা দমন, ক্ষতিকর পোকা-মাকড় ও
রোগ-বালাই দমন করতে হবে। বীজ বপনের ১১০ থেকে ১১৫ দিনের মধ্যে এই ধান পেকে
যায়। ৮০ ভাগ ধান পেকে গেলে ধান কেটে ফেলা উচিত। ধানের বীজ সংগ্রহের জন্য
ফসল কাটার পূর্্বে জমি থেকে আগাছা এবং অন্য ধানের জাত তুলে ফেলতে হবে। এরপর
বীজ হিসেবে ফসল কেটে আলাদাভাবে মাড়াই, ঝাড়াই ও ভালভাবে রৌদ্রে শুকাতে হবে,
যাতে আদ্রর্তা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে। তারপর পুষ্ট ধান বাছাই করে
প্লাস্টিক ড্রাম বা কেরোসিনের টিন ভালভাবে পরিস্কার করে শুকিয়ে রৌদ্রে
শুকানো বীজ ঠাণ্ডা করে পাত্রে রাখতে হবে।
ঠিকমতো চাষ করলে
হেক্টরপ্রতি ৫টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। এই ধানগাছ শুষ্কতা সহ্য করতে পারে,
কিন্তু ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে না। সেজন্য কোনোভাবেই এই ধানের জাত দেরীতে
চাষাবাদ করা যাবে না। এছাড়া বোরো মৌসুমেও চাষ করা যাবে না।
No comments:
Post a Comment