জুন মাস বাংলাদেশের বাজেটের মাস। কিন্তু ৭০ থেকে ৮০ ভাগ বাজেট যাদের উপলক্ষে, তারা এ বাজেটের বিষয়াদির খবর রাখার সুযোগ পায় না। অর্থাত্ কৃষকের কথা বলা হচ্ছে। যারা বাজেট প্রণয়ন করে, ব্যাখ্যা করে তারা বুঝাপড়া ও মননে-মনস্তত্ত্বে কৃষক থেকে হয়তবা অনেক দূরে; গ্রামীণ পর্যায়ের কৃষকের বাজেট ভাবনা শুনে তাই অনুমান হয়। তাই দেশে বাজেট প্রণয়নের বিষয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের স্বপক্ষে বিরাজমান ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার আলোকে বর্ণনা করা হল- বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কৃষির বিবর্তন বিবেচনায় নিয়ে বলতে হচ্ছে- কৃষক বাঁচাতে হলে কৃষকের কৃষি কাজকে অব্যাহত রাখতে কৃষকের সামাজিক জীবীকার উপর যেমন- ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, চিকিত্সা, অনুষ্ঠান সম্পাদন, আবাস, ব্যবসা প্রভৃতি খাতে ভর্তুকি দান-অনুদান দিতে হবে। এতে দেশের কৃষক দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় নিশ্চয়তা দেবে। বিশ্বের যেকোনো কৃষিভিত্তিক দেশের মত কৃষকের উত্পাদন একটা ন্যূনতম সময় কৃষকের নিজের গোলায় নিজের কর্তৃত্বে থাকবে। এতে ফড়িয়ার প্রভাব কমবে।
বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে কৃষি খামার করে টিকে থাকতে হলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে গ্রামীণ কৃষির অধিকাংশ স্থানে যে অবস্থা, ইউরোপের অনেক দেশে শতবর্ষ আগে এমন অবস্থা ছিল। কৃষির এই অবস্থার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল- কৃষির লাভ কমে যাওয়ায় শিল্পে রূপান্তর, জমি কমে গিয়ে উত্পাদন কমে যাওয়ায় আমদানি বেড়ে যাওয়া, শহরের বসতি বাড়তে থাকা, সর্বোপরি কৃষি কাজে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হতে কৃষি খামার মালিকের সামর্থ্য ও সম্পদ কমে যাওয়া। সর্মথ্য কমে যাওয়ার মধ্যে ছিল সামাজিক ও জীবীকা ব্যয় মেটাতে গিয়ে কৃষি খামারের চলতি মূলধন কমে যাওয়া, উত্পাদন ঝুঁকি মোকাবিলার শক্তি কমে যাওয়া এবং বাড়িতে বা খামারের, গোলা-গুদাম, হাল-যন্ত্রপাতি, পরিবহন, যন্ত্রপাতি বিনষ্ট করে ফেলা, এ ধরনের আরো অনেক অনুসঙ্গই। তখন সেসব দেশে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক কৃষি শিক্ষা, গবেষণা ও খামার সেবা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয় এবং দেশি আইন-বিধি পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা হয়।
কৃষি কাজকে কারিগরি স্বীকৃতি দিতে কৃষকের নাগরিক-সামাজিক কার্যাবলীর উন্নয়নের জন্য নীতিবিধান প্রণয়ন করে বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়। সে সময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জামাতা নলিনী বাবুকে লিখেছিলেন- “কৃষক পরিবারের শিক্ষা, চিকিত্সা, বাসস্থান ও বয়স্ক কৃষকের নিরাপত্তার জন্য আমাদের অনেককিছু করতে হবে”। কিন্তু বাস্তব সত্য হল- কৃষি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে আবশ্যকভাবে আধুনিক প্রযুক্তির খামার মালিকের আর্থিক ও অবকাঠামোগত সামর্থ্য রক্ষা করতে হবে। সাথে সাথে কৃষি, কৃষক, কৃষি খামার, কৃষি উত্পাদন ও কৃষি আয়-ব্যয় নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো অসত্য কথা বলা যাবে না। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিপালনযোগ্য আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে উচ্চফলনশীল জাতের উন্নত চাষ, নিজস্ব দায়িত্বে উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ফসল কর্তনোত্তর কাজ এরপর নিজের খোরাক-চাহিদা পূরণ করে বাড়তি উত্পাদন পরবর্তী কোনো সুবিধামত সময়ে উপযুক্ত দামে বিক্রি করা। এর যেকোনো একটির আধুনিক লাভজনক প্রযুক্তি ঝুঁকিমুক্তভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। এই মুহূর্তে দেশে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের একটি অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হল- কৃষকের আর্থিক সামর্থ্য নেই। কৃষি আয় কমে গেলে কৃষক তার পারিবারিক ও সামাজিক ব্যয় ঠিক রাখতে চেষ্টা করে এবং তা নিজে না যেয়ে বা হাল-গরু বিক্রি করে আর্থিকভাবে ভেতরে ভেতরে পঙ্গু হতে থাকে। তাই বাংলাদেশে কৃষি খামারের উত্পাদন বাড়াতে হলে কৃষক ও সরকার উভয়েরই করণীয় রয়েছে- প্রথমত, খামার মালিকদের সচেতন থাকতে হবে তিনি যেন কৃষি খামারের যা কিছু আয় হবে, তা কৃষি খামারের সম্পদ-সামর্থ্য বিনষ্ট করে অন্য কোনো ব্যয় না করেন। কৃষি খামারের মূলধন যন্ত্রপাতি, চলতি ব্যয়, ফসল কর্তনোত্তর সময়ের জীবীকা ব্যয় হাতে রেখে তারপর বিদ্যুত্-জ্বালানি, বাহ্যিক-বিলাস সম্পদ তৈরিতে উদ্যোগ নেবেন। মনে রাখতে হবে দেশের প্রতিটি শিল্পের গুদাম রয়েছে। পণ্য উত্পাদনের পর পর তা নিয়ে শিল্পপতি বিক্রি করার জন্য রাস্তায় বসেন না। তিনি পণ্য গুদামজাত করে তার বাজারের চাহিদার ভিত্তিতে বিপণন করে লাভবান হন। সেইভাবে কৃষককেও ফসল উত্পাদন করে প্রক্রিয়াজাত করে নিজের গোলায় তুলবেন তারপর সময় সুযোগমত উপযুক্ত মূল্য পাওয়ার সময় বিপণন করবেন।
কৃষি পণ্য কাঁচা-পাকা বিক্রি করে দিয়ে শেয়ারে ফেলবেন বা ফ্ল্যাট/প্লট কিনবেন। তারপর শেয়ারে লস খেয়ে বা ফ্ল্যাট/প্লটের দখল না পেয়ে খামারের হাল-গরু ও বসত ঘর বিক্রি করে গোলাঘরে বিছানা পাতনে, এটা কোনো কৃষকের কাজ হতে পারে না। কৃষকের লক্ষ্মী হল তার নিজস্ব খামারের কৃষি সম্পদ তার গোলাঘর এ সম্পদ অবশ্যই তাকে রক্ষা করে চলতে হবে। দ্বিতীয়ত, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চত করতে হবে। কৃষক সম্পর্কে এবং সকল দেশের প্রাথমিক উত্পাদন খাত কৃষি সম্পর্কে কোনো অসত্য তথ্য বলা যাবে না, অন্তত রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে। প্রাথমিক তথ্যে ভুল মানে সমগ্র সিস্টেমে ভুল। বাংলাদেশের কৃষি তথ্য বৈচিত্রে পরিপূর্ণ, যার নিরসন হওয়া জরুরি। এ প্রসঙ্গে বলা যায়- ভুল পথে ভতুর্কি দেয়ার চেয়ে সরকারের উচিত কৃষকের শিক্ষা, চিকিত্সা, বাসস্থান প্রভৃতি খাতে দান-ভর্তুকি দেয়া। যাতে কৃষক তার নিজের উত্পাদন অন্তত কয়েকমাস ঘরে রাখতে পারে, প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে। তা হলে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি উত্পাদন বাড়িয়ে নিজেরা লাভবান হতে পারে। সাথে সাথে সারসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণে অপচয় কমিয়ে তাকে আরো প্রতিদ্বন্দ্বীমূলক সামর্থ্য বাড়ানো। শিল্পের বা আমাদানিতে অতি ব্যয় করে সারের/উপকরণের মূল্য বাড়িয়ে সে খাতে ভর্তুকি দিলে তাতে অপচয় উত্সাহিত হয়। তাতে কৃষকের কোনো উপকার হয় না। এ সব বিষয় মাথায় রেখে দেশের সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ ও কার্যাবলী স্থির করা হলে দেশে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি বাড়বে এবং কৃষকের উন্নয়ন স্থায়ীত্বশীল হবে। কৃষি খাতে ভর্তুকি দেয়ার বাজেটের চেয়ে কৃষক পোষ্য তার সামাজিকতাকে ভর্তুকি দেয়ার বাজেট দেশের কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে পারে। এতে দেশের উন্নয়ন হবে।
No comments:
Post a Comment