বিজয়ের চল্লিশ বছর পার করেছে বাংলাদেশ। এই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্জন
হিসেবে দেখা হচ্ছে খাদ্য উৎপাদনকে। একাত্তর সালের প্রায় ১০ মিলিয়ন
হেক্টর জমিতে আবাদ হতো প্রায় ১০ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য। যা তৎকালীন সাড়ে
সাত কোটি মানুষের জন্য যথেষ্ট ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতার চার দশকে জমির
আয়তন প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেলেও খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। দেশ
আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দারপ্রান্তে। এই বিশাল অর্জনের পেছনে
দেশের আপামর কৃষক সাধারণ থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট,
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি
উন্নয়ন কর্পোরেশন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সরকারি
বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অবদান রয়েছে। কিন্তু কৃষির এই বিকাশের
সঙ্গে সঙ্গে পাল্টায়নি কৃষকের ভাগ্য। গ্রামের প্রান্তিক কৃষক ও নগরের ধনীক
শ্রেনীর মধ্যে আয়বৈষম্য বেড়েছে কয়েকগুণ। দেশের আপামর জনসাধারণের খাদ্য
গ্রহণের হারও বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, কিন্তু এই সুফল আসেনি দরিদ্র
জনগোষ্ঠির ভাগে। এখনও গবেষকদের হিসেবে দেশের ৩০ ভাগ মানুষ রয়েছে
দারিদ্রসীমার নীচে। রয়েছে অদৃশ্য দারিদ্রও। সব মিলিয়ে কৃষি ও কৃষকের
প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির গভীরে যেতে আমরা একই সঙ্গে কথা বলেছি যশোরের
বাঘারপাড়ার কৃষক সংগঠক আয়ুব হোসেন ও প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক ধান
গবেষণা ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. জয়নুল আবেদীনের সঙ্গে।
কথোপকথনের চুম্বক অংশটি তুলে ধরা হচ্ছে এখানে।
আইয়ুব হোসেন : আমার জন্ম ব্রিটিশ সময়ে। পাকিস্তানের পুরো সময়টিই আমি দেখেছি। দেখেছি দুর্ভিক্ষ ও অভাব। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে আমি দেখেছি, আমার বাবা বছরের পর বছর ক্ষেতের ফসল ঘরে তুলতে পারেননি। তখন প্রায় প্রতি বছর খরায় ধান পুড়ে যেত। সেসময় আমাদের মতো কৃষক পরিবারগুলোতে দুর্ভিক্ষ দেখেছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দুর্ভিক্ষে অনেক লোককে মারা যেতে দেখেছি। সেসময় মানুষের বেঁচে থাকার যে সংগ্রাম দেখেছি, তা আজও দেখছি। কয়েক বছর আগের সিডর ও আইলার মতে দূর্যোগের কথা যদি বলি, সেসময় খাদ্য সংকটে পড়ে, সারা পৃথিবীতে আমরা খাদ্য খুঁজেছি, কিন্তু কেউ আমাদের দিকে এগিয়ে আসেনি। আমরা বুঝেছি, কারো সহায়তা পাওয়ার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। যেভাবেই হোক আমাদেরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েই বাঁচতে হবে। সেই দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠার সংগ্রামটি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের মতোই। উপকুলীয় অঞ্চলগুলিতে যে সংগ্রাম চলছেই।
ড. অমর্ত্য সেন নোবেল পুরস্কার পেলেন এ উপমহাদেশের মানুষ কীভাবে না খেয়ে মারা যাচ্ছে ঠিক সেই বিষয়ের ওপর। তিনি দেখিয়েছেন খাবার আছেÑকিন্তু তার সুষ্ঠু বন্টনের অভাবে মানুষ খেতে পাচ্ছে না। আমাদের দেশে কৃষি উন্নয়নের জন্য উৎকৃষ্ট একটি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যা গড়ে তুলেছেন দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বিজ্ঞানীরা। যারা স্বাধীনতার পর থেকেই এদেশের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছেন। তারা একে একে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, সম্প্রসারণ বিভাগ গড়ে তুলেছেন, বিজ্ঞানস্মমত সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। এর সঙ্গে কৃষকরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, বেঁচে থাকার সংগ্রামে। এখানে বিজ্ঞানীদের উন্নয়নের সংগ্রাম আর কৃষকদের বাঁচামরার একটি সমন্বয় ঘটেছে। এই যুদ্ধের অন্যতম সেনাপতি হিসেবে এদেশের বড় বড় বিজ্ঞানীদেরকেই আজ অনেক বেশি মূল্যায়ণ করার প্রয়োজন রয়েছে।
আমাদের স্বাধীনতার পর ভিয়েতনাম স্বাধীন হয়। সেদেশের কৃষি ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য যাদের অবদান রয়েছে তার মধ্যে আমাদের দেশের কৃতী বিজ্ঞানী ড. কাজী বদরুদ্দোজাও একজন। সেই ভিয়েতনাম এখন বিশ্বের অন্যতম চাল রপ্তানীকারক দেশ। ওরা সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে আসা স্বাধীন জাতি, আমরাও। কিন্তু আমরা আমাদের ঘরে বড় বড় রতœ থাকতেও তাদের মূল্যায়ণ করতে পারিনি, তাদের শ্রেষ্ঠ চিন্তাটি গ্রহণ করতে পারিনি। এটি আমাদের অনেক বড় ব্যর্থতা।
আমাদের দেশে খাদ্যের সুব্যবস্থাপনারও অনেক বেশি ত্রুটি রয়েছে। আমরা কৃষিপণ্যের বহুবিধ ব্যবহারের শিক্ষাটি পাইনি। আলু বেশি উৎপাদন হয়েছে বলে কৃষকের মাথায় হাত পড়েছে। সে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। অথচ আমাদের দেশের পশুখাদ্যে তীব্র সংকট রয়েছে। আমরা উৎপাদিত কৃষিপণ্যকে বাছাই করে মানুষ ও কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবাদি পশুর খাদ্য সমানভাবে ব্যবহার করতে পারি।
সবকিছুর জন্য প্রয়োজন দেশের কৃষককে সংগঠিত করা। কৃষকের কথাবলার প্লাটফরম। যেটি আমাদের দেশে নেই।
ড. জয়নুল আবেদীন : বাংলাদেশের কৃষক দরিদ্র হতে পারে, ক্ষুদ্র হতে পারে, কিন্তু তার ভেতহরেই একটি শক্তি সবসময় রয়ে গেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি অপশাসন থেকে আমরা মুক্ত হই। কিন্তু আমাদের দরিদ্র কৃষকরা দারিদ্র থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যেই সবসময়ই একটা সংগ্রাম করেছে ও করছে। বহু দূর্যোগই আমাদের উপর এসেছে, কিন্তু কোন কিছুতেই এই কৃষকরা হতোদ্যম হয়ে পড়েনি। দ্রুতই নিজেদেরকে আবারো দাঁড় করিয়েছে। একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করতে চাই, যুদ্ধ করতে যেমন অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়, আমাদের কৃষকরাও সব যুদ্ধে উত্তীর্ণ হতে পারতেন না, যদি তাদের হাতে সেই অস্ত্রটি না পৌছানো যেত। প্রযুক্তি, উন্নত জ্ঞান ও উৎপাদনের অনুকুল পরিবেশ যদি তার কাছে একেবারেই না থাকতো। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কল্যাণে হেক্টরপ্রতি বেশি বেশি ধান উৎপাদনের কলাকৌশল ও উন্নত জাত কৃষকদের হাতে এসেছে ঠিকই কিন্তু একটি বিষয় সুক্ষভাবে উপলব্ধি করার প্রয়োজন রয়েছে, তা হচ্ছেÑ উৎপাদনটাই মূল বিষয় নয়। কৃষকের লাভ যদি না হয়, তাহলে উৎপাদন দিয়ে কী করবে সে ? বিভিন্ন সরকার সবসময়ই এই কাজটি করার চেষ্টা করেছে। একটি আদর্শ বাজার ব্যবস্থা গড়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা রয়েছে একথা ঠিক, কিন্তু সেচ ব্যবস্থা সুগম করা, সারে ভর্তূকি আরোপ এসব বিষয়গুলো কৃষকের যুদ্ধে সহায়তা করেছে। তবে আত্মসন্তুষ্টির কোন সুযোগ এখানে নেই। আমাদের অনেক কিছু করার ছিল, যা আমরা করতে পারিনি, এটিও মাথায় রাখার প্রয়োজন রয়েছে।
দেশের গড় জাতীয় আয় বেড়েছে, কিন্তু কৃষকের উন্নয়ন হয়নি। খাদ্যের সমবন্টন এখনও অমিমাংসিত একটি বিষয়। সরকার ও আমাদের সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে এমন একটি সেতুবন্ধন প্রয়োজন যার মধ্য দিয়ে দেশের উন্নয়নের সুফল, ধনী দরিদ্র সবার মধ্যে সমানভাবে না হলেও যতটা সম্ভব ভাগ করে দেয়া যায়। এখানে একজন শিল্পপতির আয় যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যে সমাজ থেকে যা গ্রহণ করতে পারছে, একজন কৃষক তা কোনভাবেই পাচ্ছে না।
সামগ্রিক কৃষিতে সমস্যার কলেবর বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরি প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে। নদীগুলোর নাব্যতা কমে যাচ্ছে। বহু নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে, লবণাক্ত পরিবেশের আয়তন বেড়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বিজ্ঞানী, কৃষক সবার জন্যই বর্তমান সময়টি অনেক বেশি কঠিন। এই সময়ে কৃষক, বিজ্ঞানী ও তাদের মধ্যবর্তী অবকাঠামোকে ক্ষমতায়িত করতে হবে। আর এই কাজটি করতে সবচেয়ে আগে সংগঠিত করতে হবে কৃষককে। আর বিজ্ঞানীদেরকে ক্ষমতায়িত করার জন্য সৃষ্টি করতে হবে গবেষণার উন্নত পরিবেশ। তাদের সঠিক জ্ঞান লাভের সুযোগ তৈরি করতে হবে। এদেশের ঋণের টাকায় শিক্ষা অর্জন করা কোন বিজ্ঞানী যাতে স্থায়ীভাবে বিদেশে পাড়ি না জমান, সেই দিকটি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সবার মধ্যে দেশপ্রেম ও আন্তরিকতার বিষয়টিও এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আইয়ুব হোসেন : আমার জন্ম ব্রিটিশ সময়ে। পাকিস্তানের পুরো সময়টিই আমি দেখেছি। দেখেছি দুর্ভিক্ষ ও অভাব। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে আমি দেখেছি, আমার বাবা বছরের পর বছর ক্ষেতের ফসল ঘরে তুলতে পারেননি। তখন প্রায় প্রতি বছর খরায় ধান পুড়ে যেত। সেসময় আমাদের মতো কৃষক পরিবারগুলোতে দুর্ভিক্ষ দেখেছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দুর্ভিক্ষে অনেক লোককে মারা যেতে দেখেছি। সেসময় মানুষের বেঁচে থাকার যে সংগ্রাম দেখেছি, তা আজও দেখছি। কয়েক বছর আগের সিডর ও আইলার মতে দূর্যোগের কথা যদি বলি, সেসময় খাদ্য সংকটে পড়ে, সারা পৃথিবীতে আমরা খাদ্য খুঁজেছি, কিন্তু কেউ আমাদের দিকে এগিয়ে আসেনি। আমরা বুঝেছি, কারো সহায়তা পাওয়ার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। যেভাবেই হোক আমাদেরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েই বাঁচতে হবে। সেই দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠার সংগ্রামটি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের মতোই। উপকুলীয় অঞ্চলগুলিতে যে সংগ্রাম চলছেই।
ড. অমর্ত্য সেন নোবেল পুরস্কার পেলেন এ উপমহাদেশের মানুষ কীভাবে না খেয়ে মারা যাচ্ছে ঠিক সেই বিষয়ের ওপর। তিনি দেখিয়েছেন খাবার আছেÑকিন্তু তার সুষ্ঠু বন্টনের অভাবে মানুষ খেতে পাচ্ছে না। আমাদের দেশে কৃষি উন্নয়নের জন্য উৎকৃষ্ট একটি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যা গড়ে তুলেছেন দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বিজ্ঞানীরা। যারা স্বাধীনতার পর থেকেই এদেশের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছেন। তারা একে একে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, সম্প্রসারণ বিভাগ গড়ে তুলেছেন, বিজ্ঞানস্মমত সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। এর সঙ্গে কৃষকরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, বেঁচে থাকার সংগ্রামে। এখানে বিজ্ঞানীদের উন্নয়নের সংগ্রাম আর কৃষকদের বাঁচামরার একটি সমন্বয় ঘটেছে। এই যুদ্ধের অন্যতম সেনাপতি হিসেবে এদেশের বড় বড় বিজ্ঞানীদেরকেই আজ অনেক বেশি মূল্যায়ণ করার প্রয়োজন রয়েছে।
আমাদের স্বাধীনতার পর ভিয়েতনাম স্বাধীন হয়। সেদেশের কৃষি ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য যাদের অবদান রয়েছে তার মধ্যে আমাদের দেশের কৃতী বিজ্ঞানী ড. কাজী বদরুদ্দোজাও একজন। সেই ভিয়েতনাম এখন বিশ্বের অন্যতম চাল রপ্তানীকারক দেশ। ওরা সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে আসা স্বাধীন জাতি, আমরাও। কিন্তু আমরা আমাদের ঘরে বড় বড় রতœ থাকতেও তাদের মূল্যায়ণ করতে পারিনি, তাদের শ্রেষ্ঠ চিন্তাটি গ্রহণ করতে পারিনি। এটি আমাদের অনেক বড় ব্যর্থতা।
আমাদের দেশে খাদ্যের সুব্যবস্থাপনারও অনেক বেশি ত্রুটি রয়েছে। আমরা কৃষিপণ্যের বহুবিধ ব্যবহারের শিক্ষাটি পাইনি। আলু বেশি উৎপাদন হয়েছে বলে কৃষকের মাথায় হাত পড়েছে। সে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। অথচ আমাদের দেশের পশুখাদ্যে তীব্র সংকট রয়েছে। আমরা উৎপাদিত কৃষিপণ্যকে বাছাই করে মানুষ ও কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবাদি পশুর খাদ্য সমানভাবে ব্যবহার করতে পারি।
সবকিছুর জন্য প্রয়োজন দেশের কৃষককে সংগঠিত করা। কৃষকের কথাবলার প্লাটফরম। যেটি আমাদের দেশে নেই।
ড. জয়নুল আবেদীন : বাংলাদেশের কৃষক দরিদ্র হতে পারে, ক্ষুদ্র হতে পারে, কিন্তু তার ভেতহরেই একটি শক্তি সবসময় রয়ে গেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি অপশাসন থেকে আমরা মুক্ত হই। কিন্তু আমাদের দরিদ্র কৃষকরা দারিদ্র থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যেই সবসময়ই একটা সংগ্রাম করেছে ও করছে। বহু দূর্যোগই আমাদের উপর এসেছে, কিন্তু কোন কিছুতেই এই কৃষকরা হতোদ্যম হয়ে পড়েনি। দ্রুতই নিজেদেরকে আবারো দাঁড় করিয়েছে। একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করতে চাই, যুদ্ধ করতে যেমন অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়, আমাদের কৃষকরাও সব যুদ্ধে উত্তীর্ণ হতে পারতেন না, যদি তাদের হাতে সেই অস্ত্রটি না পৌছানো যেত। প্রযুক্তি, উন্নত জ্ঞান ও উৎপাদনের অনুকুল পরিবেশ যদি তার কাছে একেবারেই না থাকতো। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কল্যাণে হেক্টরপ্রতি বেশি বেশি ধান উৎপাদনের কলাকৌশল ও উন্নত জাত কৃষকদের হাতে এসেছে ঠিকই কিন্তু একটি বিষয় সুক্ষভাবে উপলব্ধি করার প্রয়োজন রয়েছে, তা হচ্ছেÑ উৎপাদনটাই মূল বিষয় নয়। কৃষকের লাভ যদি না হয়, তাহলে উৎপাদন দিয়ে কী করবে সে ? বিভিন্ন সরকার সবসময়ই এই কাজটি করার চেষ্টা করেছে। একটি আদর্শ বাজার ব্যবস্থা গড়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা রয়েছে একথা ঠিক, কিন্তু সেচ ব্যবস্থা সুগম করা, সারে ভর্তূকি আরোপ এসব বিষয়গুলো কৃষকের যুদ্ধে সহায়তা করেছে। তবে আত্মসন্তুষ্টির কোন সুযোগ এখানে নেই। আমাদের অনেক কিছু করার ছিল, যা আমরা করতে পারিনি, এটিও মাথায় রাখার প্রয়োজন রয়েছে।
দেশের গড় জাতীয় আয় বেড়েছে, কিন্তু কৃষকের উন্নয়ন হয়নি। খাদ্যের সমবন্টন এখনও অমিমাংসিত একটি বিষয়। সরকার ও আমাদের সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে এমন একটি সেতুবন্ধন প্রয়োজন যার মধ্য দিয়ে দেশের উন্নয়নের সুফল, ধনী দরিদ্র সবার মধ্যে সমানভাবে না হলেও যতটা সম্ভব ভাগ করে দেয়া যায়। এখানে একজন শিল্পপতির আয় যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যে সমাজ থেকে যা গ্রহণ করতে পারছে, একজন কৃষক তা কোনভাবেই পাচ্ছে না।
সামগ্রিক কৃষিতে সমস্যার কলেবর বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরি প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে। নদীগুলোর নাব্যতা কমে যাচ্ছে। বহু নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে, লবণাক্ত পরিবেশের আয়তন বেড়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বিজ্ঞানী, কৃষক সবার জন্যই বর্তমান সময়টি অনেক বেশি কঠিন। এই সময়ে কৃষক, বিজ্ঞানী ও তাদের মধ্যবর্তী অবকাঠামোকে ক্ষমতায়িত করতে হবে। আর এই কাজটি করতে সবচেয়ে আগে সংগঠিত করতে হবে কৃষককে। আর বিজ্ঞানীদেরকে ক্ষমতায়িত করার জন্য সৃষ্টি করতে হবে গবেষণার উন্নত পরিবেশ। তাদের সঠিক জ্ঞান লাভের সুযোগ তৈরি করতে হবে। এদেশের ঋণের টাকায় শিক্ষা অর্জন করা কোন বিজ্ঞানী যাতে স্থায়ীভাবে বিদেশে পাড়ি না জমান, সেই দিকটি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সবার মধ্যে দেশপ্রেম ও আন্তরিকতার বিষয়টিও এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
No comments:
Post a Comment